মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১:০৮ অপরাহ্ন

নারায়ণগঞ্জ শহরের আনাচকানাচে ওসমানদের টর্চার সেল

সৌজন্যেঃ আজকের পত্রিকা
সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান

শামীম ওসমান ও তাঁর অনুসারী শাহ নিজাম চাপ দিয়ে কুতুবপুরের চেয়ারম্যান প্রার্থী হাফেজ জাকির হোসেনকে বসিয়ে দেন। একইভাবে কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদে আমাদের প্রার্থী ওমর ফারুককে রাইফেলস ক্লাবে ডেকে এনে মানসিক নির্যাতন করে তাঁকে সরে যেতে বাধ্য করেন।’ কথাগুলো বলছিলেন ইসলামী আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সভাপতি মুফতি মাসুম বিল্লাহ। সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের টর্চার সেলের (নির্যাতন কেন্দ্র) বর্ণনা তুলে ধরে এসব কথা বলেন তিনি।

গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শামীম ওসমানসহ ওসমান পরিবারের নির্যাতন কেন্দ্রের বিষয়টি ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’। এর আগেও বিভিন্ন সময় এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এ নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকে নির্যাতিত হওয়ার কথা মুখ ফুটে বলছেন। ইতিমধ্যে ওসমান পরিবারের বেশ কয়েকটি নির্যাতন কেন্দ্র ভেঙে ফেলেছেন এলাকাবাসী।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এসব নির্যাতন কেন্দ্র পরিচালনা করতেন শামীম ওসমান, তাঁর ছেলে অয়ন ওসমান, ভাতিজা আজমেরী ওসমান, ঘনিষ্ঠ অনুসারী শাহ নিজাম ও হাবিবুর রহমান রিয়াদ।

কুতুবপুরের চেয়ারম্যান প্রার্থী হাফেজ জাকির হোসেনকে যেখানে নেওয়া হয়েছিল, সেই রাইফেলস ক্লাবটি নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায়। শামীম ওসমান ও তাঁর অনুসারীদের আড্ডাখানা ছিল এটি। রাইফেলস ক্লাবকে ব্যবহার করা হতো শামীম ওসমানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের মতো। বিভিন্ন বিচার-সালিস, বৈঠক, সভার নামে প্রতিপক্ষকে দমন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল, নির্বাচন থেকে প্রার্থীদের সরিয়ে দেওয়ার আয়োজন হতো এখানে। সরকার পতনের পর ইসলামী আন্দোলনের নেতারা জানান, রাইফেলস ক্লাবে ডেকে এনে চাপ দিয়ে চেয়ারম্যান প্রার্থী হাফেজ জাকির হোসেনকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়।

নারায়ণগঞ্জ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নসিব পরিবহনের মালিকেরা সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, রাইফেলস ক্লাবে ডেকে নিয়ে নসিব পরিবহনে নতুন এমডি বসানোর জন্য চাপ দিয়েছিলেন শামীম ওসমান। এমপি হওয়ার পর পরিবহনের সব বাস দখল করে নেন শামীম ওসমানের লোকজন।

নসিব পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আল আমিন মির্জা বলেন, ‘শামীম ওসমান রাইফেলস ক্লাবে ডেকে এনে আমাদের বলেছিলেন নসিব বাসে তাঁর পছন্দের এমডি বসাতে। তখনো তিনি এমপি হননি। এমপি হওয়ার পর শামীম ওসমান তাঁর লোকজন নিয়ে বাসটি দখল করে বন্ধু পরিবহন নামে চালানো শুরু করেন।’ সরকার পতনের এক দিন আগেই ৪ আগস্ট পুড়িয়ে দেওয়া হয় ক্লাবটি।

নাসিম ওসমান মেমোরিয়াল পার্ক বা নম পার্কটির মালিক ছিলেন শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ অনুসারী ও মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম। এই পার্কে দর্শনার্থী যেত না। স্থানীয়রা জানান, ফতুল্লা ও কুতুবপুর অঞ্চলে বড় কোনো জায়গা-জমি বিক্রি করতে হলেই আসতে হতো শাহ নিজামের এই পার্কে। এখানে বসেই চলত দেনদরবার। ভূমিদস্যুতা করে সাধারণ ক্রেতা ও জমিমালিকদের নাজেহাল করতেন শাহ নিজাম। গত ১৯ জুলাই পার্কটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

সাংবাদিক নির্যাতন
সরকারি তোলারাম কলেজের ছাত্র সংসদের কক্ষ ছিল কলেজের স্বঘোষিত ভিপি ও মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদের নির্যাতন কেন্দ্র। সাংবাদিক, সাধারণ শিক্ষার্থী, ছাত্রদলের কর্মী অনেকেই সেখানে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সংবাদ প্রকাশের জের ধরে এখানে মারধর করা হয়েছিল ডেইলি স্টারের প্রতিনিধি সৌরভ হোসেন সিয়ামকে। তিনি বলেন, ‘আমি স্নাতক পড়া অবস্থায় সাংবাদিকতা শুরু করি। তখন আমার একটি প্রতিবেদন নিয়ে ক্ষুব্ধ হন শামীম ওসমানের অনুসারী রিয়াদ। তোলারাম কলেজ ক্যাম্পাসে আমাকে দেখে ছাত্র সংসদ কক্ষে ডেকে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করেন রিয়াদ ও তাঁর অনুসারীরা। এমন আরও অনেকে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সেই টর্চার সেলে।’ গত ৫ আগস্ট এই কক্ষ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

চাষাঢ়া কলেজ রোড এলাকার রূপায়ণ টাওয়ারের একটি ফ্লোরে ছিল শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমানের ব্যবসায়িক কার্যালয়। এটিও ছিল নির্যাতন কেন্দ্র। আল্লামা ইকবাল রোডে শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমানের টর্চার সেলের কথা বিভিন্ন সময় উঠে এসেছিল গণমাধ্যমে। উইনার ফ্যাশন নামের একটি কারখানায় ছিল আজমেরী ওসমানের টর্চার সেল। যেখানে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে। টর্চার সেল থেকে রক্তমাখা প্যান্টও উদ্ধার করেছিল র‍্যাব। এই ঘটনার পর উইনার ফ্যাশন থেকে টর্চার সেল সরিয়ে নিজ বাসার নিচতলায় নেন আজমেরী ওসমান। বাসার নিচে প্রায়ই বিভিন্ন ব্যক্তিকে ডেকে এনে মারধর করতেন আজমেরী ওসমান। এটিও ভাঙচুর করা হয়েছে সরকার পতনের জেরে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি ধীমান সাহা জুয়েল বলেন, ‘ওসমান পরিবার ও তাদের অনুসারীদের এসব টর্চার সেলের কথা নারায়ণগঞ্জবাসী সবাই অবগত। ভয়ে এত দিন মানুষ মুখ খুলতে পারত না। তারপরও সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ বারবার টর্চার সেলের কথা বলে গেছে। মানুষ অত্যাচারিত হওয়ার কারণেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সেলগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। আমরা চাইব নারায়ণগঞ্জ শহর হবে টর্চার সেলমুক্ত।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


ফেসবুকে উদ্যোক্তা জন সাখাওয়াত চৌধুরী'র NK-Venture-Capital