মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:০১ পূর্বাহ্ন

মাঠ প্রশাসনে এখনো আ.লীগের সুবিধাভোগীরা বহাল

সৌজন্যেঃ কালবেলা
মাঠ প্রশাসনে এখনো আ.লীগের সুবিধাভোগীরা বহাল

ঢাকা জেলার দোহার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাকির হোসেন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অমর একুশে হল ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপের শিষ্য হিসেবে পরিচিত তিনি। গোলাপের সুপারিশে ইউএনও পদে পোস্টিং পান। এর আগে ঢাকার তেজগাঁও সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে সরকারি ভিপি সম্পত্তি নিষ্পত্তির নামে নজিরবিহীন দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ঘটলেও বহাল তবিয়তে রয়েছেন জাকির।

কেবল জাকিরই নন, মাঠ পর্যায়ে দলীয় পদপদবি ব্যবহার করে পোস্টিং নেওয়া এমন কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়া এসব কর্মকর্তা এখনো সক্রিয়। ফলে সরকারের অনেক সিদ্ধান্ত মাঠ পর্যায়ে কার্যকর করা কঠিন হয়ে উঠেছে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পদে কর্মরত হোসাইন মোহাম্মদ হাই জকী। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পাওয়া এ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ছাত্রলীগের প্রভাবশালী নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রভাব খাটিয়ে বাগিয়ে নেন ৩৩তম বিসিএস প্রশাসন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পদ। আওয়ামী লীগের শাসনামলে তার ব্যাচের অসংখ্য কর্মকর্তাকে জামায়াত-শিবির ট্যাগ দিয়ে পদোন্নতি-পদায়ন বঞ্চিত করেছেন বলে অভিযোগ অনেকের। সর্বশেষ রাজউকে পোস্টিং নিয়ে এসেই দুর্নীতি করে অবৈধ টাকার পাহাড় গড়েছেন তিনি।

ফরিদপুর চরভদ্রাসনের ইউএনও মোহাম্মদ ফয়সল বিন করিম জাবি ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ফয়সাল। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। নিজ উপজেলা চৌদ্দগ্রামে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অসংখ্য মানুষের জমি দখল করেছেন ফয়সল। রাজনৈতিক পরিচয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জের ইউএনও পদে পোস্টিং নেন। কিন্তু দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হলে ঢাকার বর্তমান বিভাগীয় কমিশনার বাধ্য হয়ে তাকে বদলি করেন।

ঢাকার নবাবগঞ্জের ইউএনও কামরুল হাসান সোহেল ঢাবির সূর্য সেন হল ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি। চলতি বছর একুশে বইমেলায় ‘বাঙালির মনন গঠনে বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ’ নামে একটি বই প্রকাশ করে শেখ হাসিনার প্রতি নিজের বিশ্বস্ততা প্রমাণ করে ইউএনও পদে পোস্টিং বাগিয়ে নেন।

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের ইউএনও ইশতিয়াক আহমেদ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) শাখা ছাত্রলীগের সহ-প্রচার সম্পাদক ছিলেন। আওয়ামী লীগ সমর্থক আমলা হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিভাগের সাবেক কমিশনার খলিলুর রহমানের একান্ত সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সে সময় তার সিনিয়র ব্যাচের একজন কর্মকর্তাকে আড়াইহাজার থেকে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলায় বদলি করে নিজেই ইউএনও পদটি বাগিয়ে নেয়। ইউএনও পদে থেকে কয়েক কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এর আগে ঢাকার গুলশান সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদে থেকে দুর্নীতির টাকায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় শ্বশুরের ৫ কাঠা জমিতে ১০ কোটি টাকা মূল্যের একটি বহুতল বাড়ি নির্মাণ করেছেন।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার ইউএনও আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ছাত্রলীগের অর্থবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর ডিও লেটারের মাধ্যমে প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি পান। দলীয় আনুগত্যে ঢাকার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ইউএনও পদে পোস্টিং পান। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কয়েকজন শীর্ষ আমলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তার।

মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পাওয়া মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের ইউএনও মোশারেফ হোসাইন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-দপ্তর সম্পাদক ছিলেন। ঢাকা রমনা সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) থাকাকালীন গুনে গুনে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। চাকরির ৮ বছরে ৫০ কোটি টাকার বেশি অবৈধ সম্পদ গড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পাওয়া শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের ইউএনও রাজিবুল ইসলাম জাবি ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার কথা থাকলেও পিএসসির এক সদস্যের সুপারিশে দলীয়ভাবে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পান। সংস্কৃতি সচিবের পিএস থাকাকালে মন্ত্রণালয়ের আর্থিক কেলেঙ্কারিতেও নাম আসে তার। সাবেক চিফ হুইফ লিটন চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে মাদারীপুরের শিবচরের ইউএনও হিসেবে পদায়ন হয়। তিনি লিটন চৌধুরীকে অনৈতিক সরকারি সুবিধা দিতে যা ইচ্ছা তা-ই করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

মাদারীপুরের শিবচরের ইউএনও আব্দুল্লাহ আল মামুন খুলনার বঙ্গবন্ধু কলেজ ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। দলীয় পরিচয়ে ইউএনও হিসেবে পদায়ন করা হয় তাকে। সাবেক চিফ হুইপ লিটন চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে তার ডিও লেটার ব্যবহার করেন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর শিবচরের অনেক আওয়ামী নেতাকে নিজের সরকারি বাসভবনে আশ্রয় দিয়েছেন।

চট্টগ্রামের আনোয়ারার ইউএনও ইশতিয়াক ইমন ২০০৯ সালে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মারামারিতে ক্যাডারের ভূমিকা নিয়ে এসেছিলেন আলোচনায়। কুমিল্লার ত্রাস খ্যাত আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক এমপি আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে ইউএনও হিসেবে পোস্টিং পান।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ইউএনও কে এম রফিকুল ইসলাম জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের ক্যাশিয়ার ছিলেন। তার পক্ষে প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাকে এসিল্যান্ড ও ইউএনও পোস্টিংয়ে অর্থ বাণিজ্যের মূল কাজটি করতেন রফিকুল। সীতাকুণ্ডের ইউএনও হওয়ার আগে ঢাকার মোহাম্মদপুর রাজস্ব সার্কেলের এসিল্যান্ড হিসেবে দুর্নীতির মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা অবৈধ আয়ের অভিযোগ রয়েছে রফিকুলের বিরুদ্ধে।

কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার ইউএনও স ম আজহারুল ইসলাম বুয়েট ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। আওয়ামীপন্থি প্রভাবশালী আমলা সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ারের সঙ্গে চাকরিতে যোগদানের পর থেকে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে তার পিএস হিসেবে নিয়োগ পান। সচিবের অবৈধ সম্পদের হিসাব রাখার দায়িত্বেও ছিলেন। শেষ সময় পর্যন্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পিএস হওয়ায় আজহারুল তার ব্যাচের বিসিএস ক্যাডারদের ওপর খবরদারি করতেন।

৫ আগস্টের পর অন্তবর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে গোপন বৈঠকে ক্যু করার অভিযোগে অভিযুক্ত ঢাকার বর্তমান বিভাগীয় কমিশনার সাবিরুল ইসলামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুরের ইউএনও কাবেরী রায়ের। সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম সুপারিশ করে তার নির্বাচনী এলাকা রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলায় ইউএনও পদে পোস্টিং করান কাবেরীকে। আওয়ামী লীগ সরকার পতন হলে ঢাকার কমিশনার তাকে স্থানীয়দের রোষানল থেকে বাঁচাতে ২৫ আগস্ট এক অফিস আদেশে বালিয়াকান্দি থেকে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় পদায়ন করেন।

ঢাকার সাভারের ইউএনও রাহুল চন্দ চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ ছাত্রলীগের নেতা ছিল। সাভারের ইউএনও হওয়ার আগে বর্তমান ঢাকা বিভাগের কমিশনার সাবিরুল ইসলামের পিএস ছিলেন। আগে তিনি রংপুর বিভাগের কমিশনার থাকাকালীন সেখানেও রাহুল চন্দ তার পিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

নরসিংদী সদরের ইউএনও আসমা সুলতানা নাসরিন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নানা সুবিধা নিয়েছেন। দলটির নেতাদের নানা এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছেন। তার স্বামী মো. মিনহাজ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। স্বামীর প্রভাব খাটিয়ে পোস্টিং নিয়ে দুর্নীতি করে নিজের আখের গুছিয়েছেন। ঢাকার গুলশান এবং ধানমন্ডিতে কিনেছেন তিনটি ফ্ল্যাট। তার সহকর্মীরা জানিয়েছেন, দেড় লাখ টাকার নিচে কোনো শাড়ি পরেন না এই কর্মকর্তা।

ঢাকার ধামরাইয়ের ইউএনও খান মো. আব্দুল্লা আল মামুনের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলায়। তিনি জাবি ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। ৫ আগস্টের পর ধামরাই উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে বাঁচাতে তিনি নানা ভূমিকা পালন করেন।

ঢাকার কেরানীগঞ্জের ইউএনও মো. আবু রিয়াদ নটর ডেম কলেজ থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বুয়েট ছাত্রলীগের হল শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ছিলেন। দলীয় পরিচয়ে ইউএনও হিসেবে পদায়ন করা হয় তাকে। ছাত্রলীগ নেতা থাকাকালে তার বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ব্যাপক নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।

মাঠপর্যায়ে তাদের মতো দলীয় পদপদবির মাধ্যমে পোস্টিং নেওয়া অনেক কর্মকর্তা এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ কারণেই সারা দেশে আইনশৃঙ্খলার অবস্থার নানা চেষ্টার পরেও উন্নতি ঘটানো যাচ্ছে না। নিরপেক্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, অনেকেই নানা লবিং-তদবিরে যেমন প্রশাসন ক্যাডার পদ বাগিয়েছেন। অনেকে আবার রাজনৈতিক পদপদবির ব্যবহার করে নিয়েছেন ভালো পোস্টিং। এসব স্থানে স্থানীয় প্রশাসন সক্রিয় করার চেয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলেন রাজনৈতিক কাজে। অনেকেই ভূমিকা নিয়েছিলেন রাজনৈতিক কর্মীর। ভিন্নমত এবং অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের মানসিক নির্যাতন করতেন। ক্ষেত্রবিশেষে নানাভাবে হেনস্তাও করতেন। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরেও মাঠ পর্যায়ের এসব প্রশাসনিক পদে পরিবর্তন আনা হয়নি। ফলে সরকারের অনেক সিদ্ধান্ত ঠিকঠাক বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে সাবেক সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারি চাকরিজীবীদের রাজনৈতিক কর্মীর মতো আচরণ করার সুযোগ নেই। সিভিল সার্ভিসের যে বৈশিষ্ট্য ও গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড আছে, এটি তার পরিপন্থি। প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা রাজনৈতিক পরিচয়ে পোস্টিং নিয়েছেন বা যারা নিজের গায়ে রাজনৈতিক পরিচয় লিখে ফেলেছেন, তাদের মাঠ প্রশাসনে না রাখা উত্তম। নিশ্চয়ই এসব মার্কা মারা কর্মকর্তার বিষয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


ফেসবুকে উদ্যোক্তা জন সাখাওয়াত চৌধুরী'র NK-Venture-Capital